28
Apr
2021
শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে

Author: ফজলুল কবির মিন্টু
Media Publisher: dainikazadi

আজ ২৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস। ২০০৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করে আসছে। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস ও ব্যাপক প্রাণহানির পর বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে। মূলত রানা প্লাজা ধসের বিষয়টি স্মরণে রেখে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার, আহত বা নিহত শ্রমিকদের পেশাগত ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে দিবসটি পালন হয়ে আসছে।
শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫১ হতে ৯৯ ধারা সমূহে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। শ্রম আইনের উক্ত ধারা সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কলকারখানা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, শ্রমিকদের যাতে স্বাস্থ্য হানি না ঘটে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও যথাযথ তাপমাত্রা বজায় রাখা, প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য অন্তত ৯.৫ কিউবিক মিটার পরিমাণ জায়গার ব্যবস্থা করা, পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা, মহিলা এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য পৃথকভাবে সৌচাগার ও প্রক্ষালণ কক্ষের ব্যবস্থা করা মালিকের দায়িত্ব। একই সাথে শ্রমিকের ক্ষতি হতে পারে এমন কোন ভারী জিনিস উত্তোলন, বহন অথবা নাড়াচাড়া করতে না দেয়ার ব্যাপারেও শ্রম আইনে উল্লেখ রয়েছে।
শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নি দুর্ঘটনার কারণে অথবা অন্য কোন জরুরি প্রয়োজনে বহির্গমনের জন্য প্রত্যেক তলার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী অন্তত একটি বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমনের উপায় এবং প্রত্যেক তলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা উচিৎ।
কাজ চলাকালীন প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে কোন কক্ষ হতে বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকে রাখা যাবে না। কোন দরজা স্লাইডিং টাইপের না হলে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা বাইরের দিকে খোলা যায়, অথবা যদি কোন দরজা দুটি কক্ষের মাঝখানে হয়, তাহলে তা ভবনের নিকটতম বহির্গমন পথের কাছাকাছি দিকে খোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বহির্গমনের পথ বাধাগ্রস্ত কিংবা পথে কোন প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করা যাবে না।
প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বহির্গমনের জন্য ব্যবহৃত পথ ব্যতীত অগ্নিকাণ্ডকালে বহির্গমনের জন্য ব্যবহার করা যাবে- এরূপ প্রত্যেক জানালা, দরজা বা অন্য কোন বহির্গমন পথ স্পষ্টভাবে লাল রং দ্বারা বাংলা অক্ষরে অথবা অন্য কোন সহজবোধ্য প্রকারে চিহ্নিত করতে হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে, এতে কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিককে অগ্নিকাণ্ডের বা বিপদের সময় তৎসম্পর্কে হুঁশিয়ার করার জন্য, স্পষ্টভাবে শ্রবণযোগ্য হুঁশিয়ারী সংকেতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কক্ষে কর্মরত শ্রমিকগণের অগ্নিকাণ্ডের সময় বিভিন্ন বহির্গমন পথে পৌঁছার সহায়ক একটি অবাধ পথের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পঞ্চাশ বা ততধিক শ্রমিক/কর্মচারী সম্বলিত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করতে হবে, এবং এই বিষয়ে মালিক কর্তৃক নির্ধারিত পন্থায় একটি রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করতে হবে।
কোন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক যদি দেখতে পান যে, উহার কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে এবং তা যে কোন সময় কোন শ্রমিকের শারীরিক জখম প্রাপ্তির কারণ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তিনি অবিলম্বে লিখিতভাবে মালিককে অবহিত করবেন। মালিক অবহিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে তৎসম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে এবং উক্ত ভবন বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কোন শ্রমিক যদি জখম প্রাপ্ত হন তাহলে মালিক, অনুরূপ জখম প্রাপ্ত শ্রমিককে দ্বাদশ অধ্যায়ের অধীন উক্তরূপ জখমের জন্য প্রদেয় ক্ষতিপূরণের দ্বিগুণ হারে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন।
কোন কর্মক্ষেত্র বিশেষ করে যন্ত্রপাতি বা কাজের ধরন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে, নিয়োগ কর্তাকে সর্বপ্রথমে ঝুঁকি সমূহ দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে শ্রমিকদেরকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় সচেতনতার অভাবে কিংবা অনভ্যাসের কারণে শ্রমিকরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে অনীহা প্রকাশ করে। তাই শ্রমিকদেরকে ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহারের গুরুত্ব অবহিত করণ পূর্বক নিয়মিত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন শ্রমিকদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপের মধ্যে রাখতে হবে। যদি কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে হবে। এমন কি কোন প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কর্মরত নয় কিন্তু পূর্বে কাজ করার কারণেও যদি কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হন অথবা আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয়, তাহলে শ্রম আইনের ধারা ৮২(২) মতে উক্ত শ্রমিকের চিকিৎসার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তার। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কোন নতুন নিয়োগ দেয়ার আগে ঝুঁকি সম্পর্কে শ্রমিককে অবহিত করে নিয়োগ দান করা প্রত্যেক নিয়োগ কর্তার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শ্রম আইনের ১৫১ ধারা ও তফশীল ৫ অনুসারে কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিক মারা গেলে ২ লক্ষ টাকা এবং স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ কর্ম অক্ষম হলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, আংশিক অক্ষম হলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার আনুপাতিক হারে ক্ষতিপূরণ, অস্থায়ীভাবে কাজ করতে অক্ষম হলে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত শ্রমিক মজুরি পাবে। তবে প্রথম ২ মাস পূর্ণ মজুরি, পরবর্তী ২ মাস দুই তৃতীয়াংশ এবং পরবর্তী ৮ মাস অর্ধেক হারে মজুরি পাবে। আবার পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত অর্ধেক হারে মজুরি পাবে। কিন্তু শ্রম আইনে বর্ণিত ক্ষতিপূরণ সমূহ আন্তর্জাতিক মানের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই শ্রম আইনে বর্ণিত প্রদেয় ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে খড়ংং ড়ভ ণবধৎ ঊৎধৎহরহম, ঝঁভভবৎরহম ধহফ চধরহ এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিৎ বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। এই ধরনের ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রস্তাবিত ঊসঢ়ষড়ুসবহঃ ওহলঁৎু ওহংঁৎধহপব বাস্তবায়ন খুবই জরুরি বলে মনে করি।
জাতিসংঘ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময় সীমার এক তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শোভন কাজ বাস্তবায়ন। শোভন কাজের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কর্মক্ষত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে – জীবনের জন্য কাজ, কাজের জন্য জীবন নয়।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রতি মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যয় মূলত মূলধনী খরচ বা বিনিয়োগ। এটা কখনোই অতিরিক্ত খরচ বা অপচয় নয়। নিরাপদ কর্ম পরিবেশ শুধু শ্রমিকের জীবন বাঁচায় না উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়ায়। ফলে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য যে কোন ধরনের খরচ বা বিনিয়োগ, দীর্ঘমেয়াদে তা শিল্পেরই লাভ। আন্তর্জাতিক পেশাগত ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিবসে রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষ এ বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে এমনটিই সবার প্রত্যাশা।

28 Apr 2021
On behalf of
Implemented by

© Project Shurokkha